বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৮ রমজান ১৪৪৫

শারদীয় উৎসব, শুদ্ধি অভিযান এবং একটি করুণ মৃত্যু

প্রকাশিত : ০৯:০২ পিএম, ৯ অক্টোবর ২০১৯ বুধবার

 

কিশোরগঞ্জে সপ্তমী-অষ্টমী পুজো দেখে বিশেষত সেখানে বোরকাপড়া মহিলাসহ গণমানুষের উপস্থিতি, আনন্দ-উচ্ছ্বাস, প্রশাসনের তৎপরতায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, যে পরিবারের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছি সেই অশোক দম্পতি পারিবারের আতিথেয়তা প্রভৃতি মিলিয়ে ছিলাম বিমল এক মহানন্দে। যেন ছোটবেলার পূজার আনন্দের দিনগুলোতে চলে গিয়ে ভাবছিলাম, অষ্টমীর দিনে হয় দেবী দুর্গা ও মহিষাসুর কিংবা রাম-রাবণের মহারণ। ওইদিনই সকালে কাকতালীয়ভাবে ক্যাসিনো-দানব সম্রাট গ্রেপ্তার হলো।


দেশে অশুভের বিরুদ্ধে শুভের লড়াই শুরু হয়েছে এবং যুদ্ধে শুভ জয়লাভ করবে ভেবে আনন্দের সাথে একটা স্বস্তি অনুভব করছিলাম। আনন্দ ও স্বস্তির কারণ অভিজ্ঞতা। সেই পাকিস্তানি আমল ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ আমলেও দেখা যাচ্ছে যে, যখন আমাদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধ, যাকে বলা হয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দানা বেধে ওঠে বা জাগ্রত হয়, তখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন হিসাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুজো ও উৎসব হয় মহাসমারোহে, আনন্দ-উৎসবের ভেতর দিয়ে। আর যখন ওই চেতনার হয় দুর্দিন, তখন পুজো ও উৎসব হয় আড়ম্বরহীন। এখনও মনেপড়ে ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট যখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ‘এথনিক ক্লিনজিং’ চলাতে থাকে, তখন অনাড়ম্বর পূজা বা প্রতিবাদস্বরূপ ঘটপূজার কথা।


 কলাম লেখার সব হিসাব পাল্টে দিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাদের দ্বারা নির্মমভাবে প্রহৃত হওয়া শেরে বাংলা হলের ছাত্র আবরার ফাহাদ খুনের ঘটনা। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা যায় ওই হতভাগ্য ছাত্রটি নিহত হওয়ার মাত্র ৮ ঘণ্টা আগে ভারতকে সমুদ্রবন্দর পানি ও গ্যাস দেওয়া চুক্তির বিরোধিতা করে ফেসবুকে স্টেটাস দেওয়াটাই ছিল তার মৃত্যুর কারণ। ফেসবুক স্টেটাসটি পড়েছি। এই সমালোচনায় কিভাবে বুঝা যাচ্ছে শিবিরের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে তা বুঝতে পারা কঠিন। সে তবলীগে যেতো এমন খবরও বের হয়েছে। যায় তো কি হয়েছে! বাংলাদেশে বিরল ব্যতিক্রম বাদে সবাই তো নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্পর্শকাতর। সর্বোপরি এমনটাও জানা যাচ্ছে, ছেলেটির পরিবার আওয়ামী লীগ সমর্থক। এমন একটি ছেলেকে কয়েকজন ছাত্রনেতা মিলে পিটিয়ে মেরে ফেললো ভাবতেই মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত-বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। যে রুমে ফাহাদকে মারা হয়, তা নাকি ছিল টর্চার সেল, সেখানে মদ-অস্ত্র সবই নাকি রয়েছে। 


এবারে শারদোৎসবে সাদা মেঘের ভেলার পরিবর্তে ছিল মেঘলা আকাশ। এখানেও যেন কাকতালীয় ব্যাপার। পূজার আনন্দ-স্বস্তির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর কিরকম হচ্ছে, কি ফলাফল বয়ে আনছে, এই সফরের ভেতর দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক কোন্ পর্যায়ে পৌঁছায়, গণমানুষের মনে কি প্রতিক্রিয়া হয় প্রভৃতি খবরগুলো তেমন পর্যবেক্ষণে নিতে পারি নাই। ফেরার পথে মনে আনন্দ-স্বস্তির মধ্যে ফেসবুক খুলতেই মনের আকাশটা মতোই কালো মেঘে ছেয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় যেসব চুক্তি হয়েছে, এর কয়েকটা নিয়ে সরকারকে আর সেই সাথে ভারতকে তুলোধুনো করা হচ্ছে। সব দিয়ে দেওয়া হলো কিছুই পেলাম না এমন মন্তব্য করে তিস্তার পানি না পাওয়া সত্ত্বেও কেন দেওয়া হলো ফেনী নদীর পানি, কেন উপকূলে ভারতকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থায় যুক্ত করা হলো, চট্টগ্রাম-মোংলা সমুদ্রবন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে কেন দেওয়া হলো প্রভৃতি প্রশ্ন নিয়ে যেন ঝড় বইছে। ‘গ্যাস সংকটের মধ্যে গ্যাস রপ্তানি কতোটা যৌক্তিক’ বলে বিবিসি ভুল করে যে প্রতিবেদন দেয়, তা নিয়েও ভারত বিরোধিতায় মাঠ গরম।


সর্বোপরি একই সময়ে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, যৌথভাবে অনেকগুলো ক্ষতিকর প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ভারত। বাংলাদেশকে কয়লার ভাগার বানাচ্ছে। এক সময় পাকিস্তান নিত, পূর্ব পকিস্তান শোষিত হতো। এখন সমস্ত সুযোগ সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে ভারত। এই জায়গায় মনে হয় চিন্তা ভাবনার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ‘ভাস্কর্য না থাকলে মসজিদ থাকার দরকার নেই’ ২০১৭ সালে হাইকোর্ট চত্বরের ভাস্কর্য সরানো নিয়ে মন্তব্য করে যিনি কোন্ ধর্মের অনুসারি, নাস্তিক, ভারতের দালাল, ঘাড় ধরে দেশ থেকে বের করে দেওয়া দরকার, জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলে দিব ইত্যাদি বলে অন্ধ সাম্প্রদায়িক ভারত বিরোধীদের গালি শুনছিলেন, এখন তিনি ভারতের বিরোধিতার বিষয়ে চিন্তা করার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর থেকে ফিরে এসে এসব বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কি বলেন তা নিয়ে গভীর আগ্রহ নিয়ে ভাবলাম; ভারতের সাথে সম্পর্কের ওঠাপড়া কিভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঘাত করে, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক চেতনাকে জাগ্রত করে, বিশেষভাবে তা আমাদের দেশের মানুষের জন্য কতটা ক্ষতিকর প্রভৃতি নিয়ে আগামী সংখ্যার কলামে লিখবো ভেবেছিলাম।


কিন্তু কলাম লেখার সব হিসাব পাল্টে দিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাদের দ্বারা নির্মমভাবে প্রহৃত হওয়া শেরে বাংলা হলের ছাত্র আবরার ফাহাদ খুনের ঘটনা। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা যায় ওই হতভাগ্য ছাত্রটি নিহত হওয়ার মাত্র ৮ ঘণ্টা আগে ভারতকে সমুদ্রবন্দর পানি ও গ্যাস দেওয়া চুক্তির বিরোধিতা করে ফেসবুকে স্টেটাস দেওয়াটাই ছিল তার মৃত্যুর কারণ। ফেসবুক স্টেটাসটি পড়েছি। এই সমালোচনায় কিভাবে বুঝা যাচ্ছে শিবিরের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে তা বুঝতে পারা কঠিন। সে তবলীগে যেতো এমন খবরও বের হয়েছে। যায় তো কি হয়েছে! বাংলাদেশে বিরল ব্যতিক্রম বাদে সবাই তো নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্পর্শকাতর। সর্বোপরি এমনটাও জানা যাচ্ছে, ছেলেটির পরিবার আওয়ামী লীগ সমর্থক। এমন একটি ছেলেকে কয়েকজন ছাত্রনেতা মিলে পিটিয়ে মেরে ফেললো ভাবতেই মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত-বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। যে রুমে ফাহাদকে মারা হয়, তা নাকি ছিল টর্চার সেল, সেখানে মদ-অস্ত্র সবই নাকি রয়েছে।


স্বাধীনতার আগে এই বয়সের ছাত্রনেতারা সাধারণ ছাত্রদের উজ্জীবিত করে ৬ দফা, ১১ দফা আন্দোলনে, মুক্তিযুদ্ধে নামিয়েছে। স্বাধীনতার পরও ছাত্র নেতাদের স্বৈরাচার বিরোধী গণতন্ত্র তথা ভোট ও ভাতের অধিকারের দাবিতে সংগ্রামে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আর আজ! এই অনভিপ্রেত ঘটনা ষাটের দশকের সরকারি দল এনএসএফের জমির আলী-খোকা-পাচপাত্তুর গংদের স্মরণ করিয়ে দেয়। একই সাথে স্মরণে আসে, ১৯৭৪ সালে সূর্যসেন হলে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে ৭ জন ছাত্রের নিহত হওয়ার এবং ২০০২ সালের জুন মাসে ক্ষমতার রাজনীতির টানাপোড়েনে ‘দুষ্টু ছেলে’ পিন্টুর ছত্রছায়ায় ছাত্রদলের দুই গ্রুপ টগর-মুকি গ্রুপের বন্দুক যুদ্ধে সাবেকুন নাহার সনি নিহত হওয়ার প্রভৃতি মর্মান্তিক ঘটনা। ওইসব ঘটনার চাইতেও এই ঘটনা আরো পৈশাচিক, আরো মারাত্মক। হায়রে ক্ষমতার রাজনীতি! যেসব ছাত্রনেতারা মেরেছে, তারাও কিন্তু ভালো ছাত্র। ক্ষমতার লোভ-স্বাদ কতই না হয় মারাত্মক! ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতার রাজনীতিতে শিক্ষাঙ্গন তথা ছাত্র ও শিক্ষকদের যথেচ্ছ ব্যবহার ও দলাদলি আর টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজি দখলবাজি করতে দেওয়ার পরিণতি হচ্ছে এই মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ড!


নির্মম ও বাস্তব সত্য হলো আওয়ামী লীগের ১১ বছরের ধারাবাহিক শাসন এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারলো না। প্রসঙ্গত ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শোভন-রব্বানীর পদত্যাগ ও যুবলীগের ক্যাসিনো পাণ্ডাদের গ্রেপ্তার তথা শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর বিশেষত পুজোর মধ্যে যাদের সাথে কথা হয়েছে, তারা সন্দেহ সত্ত্বেও আস্বস্ত হয়ে বলেছেন, এবার ঠিক পথে এগুবে দেশ। কিন্তু ঘোরপোড়া গরুর মতো অভিজ্ঞতা বিবেচনায় শংকিত থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। অভিজ্ঞতা বলে শুদ্ধি অভিযান কিন্তু শুদ্ধির পথে ধারাবাহিকভাবে সরলপথে যায় না। বরং আরো আরো ঘটনা ঘটে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে জটিল-কঠিন, অস্থির-অরাজক। যেন চলে যায় নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায়। এটা পেন্ডোরার বাক্স যেন খুলে যায়। বঙ্গবন্ধুর আমলে শুদ্ধি অভিযানে সামরিক বাহিনীকে নামানো হয়েছিল, নকল নোট আর কালোবাজারির মাল ও ক্ষমতাসীন দলের পান্ডাদের আটক করা হয়েছিল, জরুরি আইন জারি করা হয়েছিল।


কিন্তু তা কি কমেছিল? খুনি ‘রাতের বাহিনী’ এবং লবণ চোরসহ ‘চাটারদল’-এর দুর্দমনীয়তা কমে নাই। বরং অশান্ত-অস্থির পরিবেশ হচ্ছিল। একদল ছিল এর পরিণতি। ২০০২ সালে প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে দ্রুত বিচার আইনে সনি হত্যাকারীদের ফাঁসি হয়েছিল। কিন্তু তা থেকে কি শিক্ষা নিয়েছিল বিএনপির ক্যাডার বাহিনী! শোভন-রব্বানী অথবা সম্রাট-জিসান গংদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়েছে কি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতারা! বরং সচেতন বা অবচেতনভাবে প্রধান-পিন্টুর পথ ধরেছিল। সবারই জানা, অধঃপতিত প্রধান মুক্তি পেয়ে ক্ষমতাসীন জোটে স্থান করে নিয়েছিল কিংবা পিন্টুর মতো ঘৃণিত ব্যক্তি এমপি হয়েছিল। বলাই বাহুল্য এদের যেমন কোনো দল নেই, তেমনি ক্ষমতাসীন হলে দলের আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদাররা তাদের দলে স্থান করে দেয়। প্রবাদ তো বলেই রতনে রতন চিনে!


অবস্থা পর্যবেক্ষণে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ক্ষমতা ব্যবহার করে করে আন্ডারওয়ার্ল্ড এক সময় হয়ে ওঠে মহাশক্তিবান, দানব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায় মনস্টার, ফ্রাক্টেনস্টাইন। প্রতিষ্ঠানিক ক্ষমতার চাইতে তারা নিজেদের মনে করো শক্তিশালী। এতে যুক্ত থাকে ক্ষমতাসীন-বিরোধী দলের পান্ডারা, প্রশাসন, উঠতি ব্যবসায়ী, আইনজীবী, সাংবাদিক প্রভৃতি সব। তৈরি হয় অসুররূপী অশুভ নেকসাস। এরাই যেন অদৃশ্য সুতার টানে সবকিছুকে হয় পূর্বাবস্থায় ফেরা অথবা অরাজকতা-অস্থিরতা-অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে চায়। স্থান কাল পাত্র ভেদে জোকের মতো রক্তচোষা এরা। এরা যেন রক্তবীজের দল। একের পতন মানে তো আরো আরো অসুরের জন্ম। এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, জেলখানা থেকেও এইসব খুনি ও ক্যাসিনো সম্রাটরা বাইরে অন্ধকার জগতের সাথে যোগাযোগ রাখবে এবং মনে করতে থাকবে যে, প্রধান বা পিন্টু হবে তারা! আর কে জানে, গডফাদাররা ভেতরে ভেতরে হয়তোবা ভাবছেন মোশতাক, তাহেরউদ্দিন গংদের মতো একসময় ক্ষমতাসীন হবে। যখন গায়ে তেল বাড়ে তখন করুণ পরিণতির কথা আদৌ মনে থাকে না।


তাই অসুরদের ধরেছে বা যথাযোগ্য শাস্তি হবে ভেবে খুশি বা আত্মসন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। বরং মৌমাছির চাকে ঘা পড়ার মতো পরিস্থিতি হতে পারে, এমনটা স্মরণে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। প্রসঙ্গত অন্ধকার জগতের গডফাদাররা সাধারণভাবে চামচাগিরি করে। এরা বর্ণচোরা। প্রবাদ আছে, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। দলে, সমর্থক বা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ভালো-মন্দ সমালোচনা যিনি বা যারা করেন, তারাই হচ্ছে ক্ষমতার প্রকৃত বন্ধু। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর খুনি মোশতাক কিভাবে কাঁদেছিল সেই দৃশ্যটা স্মরণ করলেই সব পরিষ্কার হয়ে উঠবে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার সাড়ে চার মাস আগে ৩০ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পিতার মৃত্যু হয়েছিল। বেঁচে থাকলে মোশতাকের লেলানো সেনাসদস্য অসুরদের গুলিতে তাঁর কি পরিণতি হতো, তা চোখের সামনে ভেসে উঠলে মনে হয় বঙ্গবন্ধুর আগে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে ভালোই হয়েছিল।

প্রসঙ্গত একটা কথা বলতেই হয় যে, অন্ধকারের এইসব শত্রুরা যখন পাল্টা আঘাত হানে বা ফিরে আসে, তখন হয় আরো নৃশংস ও ভয়ঙ্কর। তাই শুদ্ধি অভিযানের বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং তা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনাটা বিশেষভাবে প্রয়োজন। ধর্মীয় মিথ মানুষ সৃষ্টি করার সময় থেকে অভিজ্ঞতাপ্রসুত উপলব্ধী থেকে বাঙালি সংস্কৃতি অকালবোধন বা প্রতিবছর দুর্গাপুজো শুরু করেছে। যেমন শেষ নেই এই বাংলায় অসুরদের, তেমনি এই আবাহন ও বিসর্জনের কোনো শেষ নেই। যদি শেষ থাকতো তবে আরবে আইয়ামে জাহিলিয়াত শেষ হওয়ার পর বিদায় হ্বজের ভাষণ কিংবা পবিত্র হওয়ার জন্য ঈদোৎসবের আয়োজন থাকতো না।


মানুষের রক্ত যেমন এক, স্বভাবের বৈচিত্র্য তেমনি দেশ কাল পাত্রভেদে একই। সত্ত্বগুণ, রজোগুণ, তমোগুণ মিলেই মানব সমাজের অগ্রযাত্রা চলছে। অসুরকে দেশমাতার পায়ের নিচে রাখা কিংবা কোরবানী দিয়ে শুদ্ধ হওয়া একই কথা। শরদীয় প্রভাতে বাংলার মায়ের সবুজ আঁচলে শুভ্র ও লালচে-কমলা শেফালির হাসি, উদার আকাশের উড়ন্ত সাদা মেঘ, লক্ষ্য অভিমুখে ছুটে চলা নদী পাড়ের শ্বেতশুভ্র কাশবন, পবিত্র আরতির আলোর মঙ্গলচ্ছটা আর অসুর-বিজয়ের উৎসবের ঢাকঢোলের বাদ্য যেন এবারে শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে বলে দিয়ে যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত পদানত করে রাখ সমাজের গজিয়ে ওঠা অসুরদের। বিজয়ী হও শুভ। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও গৌরব ধরে রাখ।


আমাদের এই মানচিত্রের বাঙালি জাতি তথা জাতীয় মূলধারা আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা হচ্ছে, নেতা থেকে আমরা পেতে চাই সবকিছু। কিন্তু নেতার ভাষা আমরা সবসময় বুঝতে পারি না। সবচেয়ে কম পারে মনে হয় ধাপে ধাপে আসন পাওয়া নেতা-কর্মীরা। বঙ্গবন্ধুর মনের ভাষা আমরা বুঝতে পারি নাই। বঙ্গবন্ধু এগিয়ে যাও বলেছি, বিজয়ের স্লোগান দিয়েছি; কিন্তু কথা ও কাজের মর্মবাণী নিয়ে অগ্রসর হতে পারি নাই। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু কন্যার ভাষা কেন যেন জাতি তেমন বুঝতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুদ্ধি অভিযান শুরু করার পর ‘যতটুকু ভালো করেছি তার প্রচার করার’ অনুরোধ জানিয়ে ২ অক্টোবর বলেছেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের মন মানসিকতা হলো, সরকারে যারাই থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে একটু কথা না বললে নাকি আকর্ষণ থাকে না। সরকারের বিরুদ্ধে কথায় আপত্তি নেই, অপপ্রচার যেন না হয়। কেননা অপপ্রচারে মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, দিশেহারা হয়ে যায়।’ কিন্তু কি দুর্ভাগ্য! সমালোচনা করতে গিয়েই নাকি বুয়েট ছাত্রের মৃত্যু হলো। যা শুদ্ধি অভিযানের আত্মবিশ্বাসকে যেন ফিকে করে দিচ্ছে। পবিত্র বিজয়া দশমীর এই দিনে দুর্গামায়ের অসুর বিজয়ের মতো প্রধানমন্ত্রীর মনস্টার বিজয়ের একান্ত সাফল্য কামনা করছি।