শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৯ রমজান ১৪৪৫

সরকারি বড় কাজ গুলো ছিল যুবলীগ নেতা শামীমের কবজায়

প্রকাশিত : ১২:৪৩ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার

তিনি চলাফেরা করতেন গডফাদারের মতো। সঙ্গে তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন দেহরক্ষী। বহরে থাকত অন্তত তিনটি গাড়ি। সাইরেন বাজাতে বাজাতে রাস্তা অতিক্রম করতেন। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে দেহরক্ষীরা তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখতেন। রাজধানীর নিকেতন এলাকায় তিনি প্রবেশ করলেই সবাই তাঁর উপস্থিতি টের পেতেন।

এই মহাক্ষমতাধর ব্যক্তির নাম এস এম গোলাম কিবরিয়া ওরফে শামীম। নিজের নাম সংক্ষেপ করে বলতেন জি কে শামীম। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্সের মালিক তিনি। নিজেকে পরিচয় দিতেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক বলে। গতকাল শুক্রবার র‍্যাব সদস্যরা তাঁর কার্যালয়ে হানা দিয়ে তাঁকে ও তাঁর সাত দেহরক্ষীকে গ্রেপ্তার করেন। এরপর সেখান থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র (তাঁর মায়ের নামে ১৪০ কোটি), ৯ হাজার ইউএস ডলার, ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার, একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং মদের বোতল জব্দ করা হয়েছে। র‍্যাব বলছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযান।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় কলাবাগান ক্রীড়া চক্র ও ধানমন্ডি ক্লাবে অভিযান চালায় র‍্যাব। অভিযান শুরুর আগে কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি অস্ত্রসহ শফিকুল আলমকে আটক করা হয়। শফিকুল স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া ধানমন্ডি ক্লাবের বার সিলগালা করে দেয় র‌্যাব।

র‍্যাবের অভিযানের সময় শামীমের ঠিকাদারি কার্যালয়ে ঢুকেই দেখা গেল, অভ্যর্থনাকক্ষের দেয়ালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. কাওসার, র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহানের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শামীমের অন্তরঙ্গ ছবি টানানো। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ের গাড়ি পার্কিংয়ের পর নকশাখচিত দুই পাল্লার দরজা পেরিয়ে ভবনটির যত ভেতরে ঢোকা গেল, ততই জৌলুশ চোখে পড়ে। তৃতীয় তলায় প্রায় ৩০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া শামীমের বসার কক্ষটি দামি বাতি, কাঠ দিয়ে সাজানো। বড় আকারের দুটি টিভি, তিন সেট সোফা ও একটি বড় টেবিল রয়েছে সেই কক্ষে। সেই টেবিলের ওপরই গতকাল র‍্যাব তাঁর কাছ থেকে জব্দ করা টাকার বান্ডিল, মদের বোতল ও অস্ত্র সাজিয়ে রেখেছিল।

গত বুধবার যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গুলশানে তাঁর নিজ বাসা থেকে আটক করে র‍্যাব। একই দিন ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে তাঁর পরিচালিত অবৈধ ক্যাসিনোতেও অভিযান চালানো হয়। খালেদের গ্রেপ্তারের পরপরই শামীমের নাম আলোচনায় আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান অনেক নেতাই তাঁকে নিয়ে মন্তব্য করেন। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকা ছয় দেহরক্ষীসহ তাঁর একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে।

রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় শামীম ছিলেন ঢাকা মহানগর যুবদলের সহসম্পাদক এবং সে সময়কার এক মন্ত্রী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠজন। সরকার বদলের পর তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। অভিযোগ রয়েছে, গণপূর্ত ভবনের ঠিকাদারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন এই জি কে শামীম। সেখানে তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কারও কাজ পাওয়া দুরূহ। সরকারি বড় কাজগুলো এখনো তাঁর কবজায়।

দরপত্র নিয়ন্ত্রণের এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল গতকাল তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের দেওয়া তথ্য থেকেই। প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপক আমির হামজা জানান, শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ১৬টি সরকারি প্রকল্পের কাজ করছে। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর আশকোনায় র‍্যাবের সদর দপ্তর, গাজীপুরের পোড়াবাড়িতে র‍্যাব ট্রেনিং সেন্টার, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবন, পঙ্গু হাসপাতাল, এনজিও ভবন, নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ভবন, বিজ্ঞান জাদুঘর, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবন, ক্যাবিনেট ভবন, বাসাবো বৌদ্ধমন্দির, হিল ট্রেকস ভবন, মিরপুর ৬ নম্বরের স্টাফ কোয়ার্টার, সেবা মহাবিদ্যালয় এবং মহাখালী ক্যানসার হাসপাতাল নির্মাণের কাজ প্রতিষ্ঠানটি করছে।

শামীম ও তাঁর সাত দেহরক্ষীকে গ্রেপ্তারের পর র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সরোয়ার বিন কাশেম সাংবাদিকদের পুরো ঘটনার বিবরণ দেন। কী অপরাধে শামীম ও তাঁর দেহরক্ষীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে তাঁর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি পত্রপত্রিকায় এসেছে। এ ছাড়া তাঁর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ পাওয়া গেছে। এগুলো মানি লন্ডারিংয়ের আওতায় আনা হবে। পুরো বিষয় তদন্ত করে জানানো হবে।

অভিযানে থাকা র‍্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, শামীমের মায়ের কোনো ব্যবসা নেই। তারপরও তাঁর নামে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে। তাঁর দেহরক্ষীরা অস্ত্র প্রদর্শন করে বিভিন্ন জায়গা থেকে সুবিধা নিতেন। বৈধ কাজের আড়ালে কোনো অবৈধ কাজ করা হচ্ছিল কি না, সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে। জব্দ অস্ত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, অস্ত্রগুলো বৈধ হলেও অবৈধ কাজে ব্যবহারের অভিযোগ থাকায় জব্দ করা হয়েছে। শামীমের রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না, তা নির্ধারণ করবেন তাঁর দল ও নেতারা। এ দায়িত্ব র‌্যাবের নয়।

তবে শামীমকে গ্রেপ্তারের পর যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমান, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন সময়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

র‍্যাবের সংবাদ সম্মেলনের পরপরই শামীমের ব্যক্তিগত সহকারী দিদারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের বিভিন্ন নির্মাণকাজ চলমান থাকায় প্রতিদিনই শ্রমিকদের টাকা দিতে হয়। এই অঙ্ক অনেক বড়। শুক্র ও শনিবার ব্যাংক বন্ধ থাকায় বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী ক্রয় ও শ্রমিকদের দেওয়ার জন্য টাকা তুলে রাখা হয়েছিল।

কলাবাগানে অভিযান

টানা এক ঘণ্টার অভিযানে কলাবাগান ক্রীড়া চক্র ক্লাব ভবন থেকে অস্ত্র, ইয়াবা বড়ি, ক্যাসিনো খেলার কয়েন এবং ৫৭২টি প্লেয়িং কার্ড সেট উদ্ধার করেছে র‍্যাব। এসব সরঞ্জাম ক্লাবটির সভাপতি শফিকুল আলমের অফিস কক্ষ থেকে পাওয়া যায়। র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গাউসুল আজমের নেতৃত্বে এই অভিযান চালানো হয়।

 অভিযান শেষে ক্লাব প্রাঙ্গণে র‍্যাব-২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাল বলেন, রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনো, জুয়ার আড্ডা ও বারের বিরুদ্ধে যে অভিযান চালানো হচ্ছে, এরই চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কলাবাগান ক্লাবে অভিযানটি চালানো হয়। অস্ত্র ও ইয়াবাগুলো ক্লাবটির সভাপতি শফিকুল আলমের অফিস কক্ষে পাওয়া গেছে। তিনিসহ হারুন, আনোয়ার, হাফিজুল ও লিটন নামের পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা হবে বলে জানা গেছে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাইলে র‍্যাব-২-এর অধিনায়ক বলেন, তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় ওপেন সিক্রেট। এটি মনে হয় সবাই জানেন।

এর আগে গতকাল সন্ধ্যায় এই অভিযান শুরু করে র‍্যাব-২-এর একটি দল। অভিযানের আগে দুপুরে ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলমকে ক্লাব থেকে র‍্যাব-২-এর কার্যালয়ে নেওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁকে নিয়ে ক্লাবে অভিযান শুরু হয়।

র‌্যাব সূত্র জানায়, কলাবাগান ক্লাবই প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ক্যাসিনো চালুর উদ্যোগ নেয়। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্যাসিনো বন্ধ হয়ে যায়। কলাবাগান ক্লাবের আদলে প্রথমে ভিক্টোরিয়া ও পরে একে একে ওয়ান্ডারার্স, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা, মোহামেডান, আরামবাগে স্লট মেশিন বসে। তবে সেখানে যাতায়াত ছিল এমন একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, কলাবাগানে স্লট মেশিন জুয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মানের বোর্ড, নেপাল থেকে প্রশিক্ষিত নারী-পুরুষদের নিয়ে আসা হয়। প্রথমে ক্লাবগুলোয় বাকারা (তাসের খেলা) নামের একটা খেলা হতো, পরে যুক্ত হয় রুলেট (চাকার মতো বোর্ড) এবং আরও কয়েকটি খেলা। এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক নাজমুল করিম ওরফে টিঙ্কু। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মোহাম্মদপুরের ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম। এখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা কারবারি, পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল। নাজমুল করিম মারা যাওয়ার পর টাকাপয়সা হস্তগত করায় মহল্লার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। এর সমাধান না হওয়ায় ক্লাবটি একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিদিন কলাবাগান ক্লাবের আয় ছিল প্রায় কোটি টাকা।

কলাবাগান ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ ছিল শফিকুল আলমের হাতে। তিনি এলাকায় ফিরোজ নামে পরিচিত। একসময় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ছিল। চাঁদপুরের একটি আসন থেকে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নও চেয়েছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

কলাবাগানে অভিযানের পর ধানমন্ডি ক্লাবে অভিযান চালায় র‍্যাব। র‍্যাব ২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাল প্রথম আলোকে বলেন, রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁরা অভিযান চালান। সেখানে জুয়া খেলা বা ক্যাসিনোর কোনো আলামত পাননি। তাদের একটি বার রয়েছে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ এর লাইসেন্স রয়েছে বলে দাবি করেছে। বারটি ২৪ ঘণ্টার জন্য সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বৈধ কাগজপত্র দেখালে আবার খুলে দেওয়া হবে।