বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৮ রমজান ১৪৪৫

ঢাকার পরিবহন

রিকশা বন্ধে সমস্যার সমাধান হবে না

তরুণ কন্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত : ০২:০৬ পিএম, ১১ জুলাই ২০১৯ বৃহস্পতিবার

রাজধানীর তিন সড়কে রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে 'ঢাকার রিকশা'। রিকশা বন্ধের প্রতিবাদে এর চালক-মালিকরা আন্দোলন করছেন। তাদের রাজপথ অবরোধে নগরজীবনে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। তবে অনেকেই মনে করছেন, যানজট নিরসনে প্রধান সড়ক থেকে রিকশাসহ সব অযান্ত্রিক যানবাহন তুলে দেওয়াই যৌক্তিক। 

এদিকে নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিকশা তুলে দেওয়ার আগে গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন, যা করা হয়নি। রাজধানীর সব ফুটপাতও পথচারীদের ব্যবহারের যোগ্য নয়। জ্যামিতিক হারে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। রাজপথের একটি বড় অংশই চলে গেছে তাদের দখলে। এসব কারণে বর্তমানে গণপরিবহনের গতিবেগ তলানিতে ঠেকেছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, এ অবস্থায় প্রধান সড়ক থেকে রিকশা তুলে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তবে রিকশা তুলে দিলেই যে রাজধানীর যানজট দূর হয়ে যাবে- সেটাও কেউ মনে করেন না। 

তাহলে এ সমস্যার সমাধান কী? এ প্রসঙ্গে নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, ঢাকা শহরে এমনও এলাকা আছে, যেখানে এক বর্গকিলোমিটার জায়গায় ৪০ হাজার মানুষের বাস। এ অবস্থায় সুপরিসর ফুটপাত, যানজটমুক্ত রাস্তা, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র, পার্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল- এসব নাগরিক সুবিধা কোনোভাবেই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সাড়ে তিনশ' বর্গকিলোমিটার আয়তনের মূল ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস। এ রকম শহরে শৃঙ্খলা ফেরাতে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার- যেটাই করেন না কেন, একে বাসযোগ্য করা সম্ভব না। তিনি মনে করেন, ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ৫০ লাখে নামিয়ে আনলেই কেবল সমস্যার সমাধান হবে। না হলে শুধু রিকশা তুলে দেওয়া কেন, কোনোভাবেই এ শহরে শৃঙ্খলা আনা যাবে না। তিনি আরও বলেন, অনেক দেশেই রাজধানী স্থানান্তরের নজির আছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারত এবং মিয়ানমারও রাজধানী স্থানান্তর করেছে। প্রয়োজনে বাংলাদেশের রাজধানীও স্থানান্তর করতে হবে। 

৩৪৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজধানীতে বৈধ রিকশার সংখ্যা ৭৯ হাজার ৭০৭টি। ১৯৮৭ সালের পর ঢাকা সিটি করপোরেশন নতুন কোনো রিকশার লাইসেন্স দেয়নি। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদেই বেড়েছে রিকশা। বর্তমানে এর সংখ্যা প্রায় আট লাখের মতো। আর রিকশাচালকের সংখ্যা অন্তত ১০ লাখ। প্রতিটি রিকশার সঙ্গে অন্তত একটি পরিবার নির্ভরশীল। কাজেই রাজধানী থেকে রিকশা উচ্ছেদ করলে বিপুল জনগোষ্ঠীর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার একটি আধুনিক শহরে পাচালিত রিকশা চালানোও অমানবিক। 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, তিনটি সড়কে রিকশা বন্ধ করার আগে কোনো গবেষণা হয়নি। রিকশা বন্ধ করতে হলে মানুষের চলাচলের বিকল্প ব্যবস্থাও করতে হবে। সেটাও করা হয়নি রিকশা বন্ধের আগে। সব জায়গায় পথচারীবান্ধব ফুটপাতও নেই। নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে আলোচনা না করে হঠাৎ রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বলা হচ্ছে, রিকশা তুলে দিলে যানজট কমবে। বিষয়টি মোটেও সে রকম না। কারণ রিকশাই যানজটের অন্যতম কারণ না। ব্যক্তিগত গাড়ি এর অন্যতম কারণ। কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেই। 

নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, একটি বাসযোগ্য ও আধুনিক শহরের ২৫ শতাংশ জায়গায় রাস্তা থাকা প্রয়োজন। অথচ রাজধানীতে বর্তমানে আছে মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ। এমনিতেই এখানে রাস্তার পরিমাণ প্রয়োজনের তিন ভাগের মাত্র একভাগ, তার ওপর ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। 

বিআরটিএ সূত্র জানায়, বর্তমানে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেটকার) রয়েছে প্রায় চার লাখ। এ ছাড়া মাইক্রোবাস আছে ৭০ হাজার। সিএনজি অটোরিকশা আছে প্রায় ২৫ হাজার। অথচ বিপরীতে বাসের সংখ্যা মাত্র আট হাজার। রাজধানীর বেশিরভাগ মানুষের যাতায়াতের মাধ্যম গণপরিবহনের সংখ্যাই সবচেয়ে কম। রাস্তার একটি বড় অংশই দখল করে রাখছে প্রাইভেট কার। কিন্তু সরকার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে কখনোই উদ্যোগ নেয়নি। এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলেও সেটি ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। রাজপথে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাস কোম্পানিগুলোকে একটি ছাতার নিচে আনার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন হয়নি। সব মিলিয়ে পরিবহন খাতেও চলছে নৈরাজ্য।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, কোনো শহরে গণপরিবহনের গড় গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারের নিচে নেমে এলে সেই শহরকে মৃত শহর (ডেড সিটি) বলা হয়। বর্তমানে ঢাকায় গণপরিবহনের গড় গতি এর চেয়েও কম। ব্যক্তিগত গাড়ির মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা এবং একই সড়কে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহনের চলাচল এই ধীরগতির কারণ। 

বিশ্ব্যাংকের হিসাবে যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে নগরবাসীর। আর বুয়েটের হিসাবে প্রতি বছর এ কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতির গতির লাগাম টেনে ধরছে যানজট। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, রাজধানীর গণপরিবহনের গতি বাড়ানোর জন্যই তিনটি সড়কে রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কোনো মেগা সিটির প্রধান সড়কে রিকশা চলতে পারে না। তিনি বলেন. যে দুটি সড়কে রিকশা বন্ধ করা হয়েছে, সেখানে এরই মধ্যে বেশ কিছু নতুন বাস নামানো হয়েছে। প্রয়োজনে আরও বাস নামানো হবে। তিনি বলেন, মিরপুর রোডে রিকশা বন্ধ করার পর ওই সড়কে যানজটের পরিমাণ অনেক কমেছে। 

অবৈধ রিকশা উচ্ছেদে অভিযান নেই :অবৈধ রিকশা উচ্ছেদে অতীতে বিভিন্ন সময় অভিযান চললেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবৈধ রিকশা উচ্ছেদ করা হয়নি। এ সুযোগে বিভিন্ন সংগঠন তাদের নামে রিকশার রেজিস্ট্রেশন দিয়ে চলেছে। আরেকটি সংগঠন আদালতে মামলা ঠুকে এসব রেজিস্ট্রেশন দেওয়া রিকশা চলার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইনসুর আলী বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ রিকশা উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে আসছেন। অবৈধ রিকশা উচ্ছেদ করলে রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে রিকশা উচ্ছেদের প্রয়োজন পড়ত না।

বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান মালিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আর এ জামান বলেন, তারাও চান, অবৈধ রিকশা উচ্ছেদ করা হোক। কিন্তু কেন করা হচ্ছে না, সেটাই মূল প্রশ্ন। 

রিকশা-ভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন বলেন, চারটি প্রতিষ্ঠান অবৈধ রিকশার লাইসেন্স দিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংগঠন আদালতে মামলা ঠুকে অবৈধ রিকশা উচ্ছেদে বাধা সৃষ্টি করছে। আদতে সেটিতে মুক্তিযোদ্ধা কেউ নেই। অবৈধ রিকশা তুললে প্রধান সড়কেও রিকশা বন্ধের প্রয়োজন হবে না। 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম জানান, তারা সব সড়কে নয়, কেবল প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা বন্ধের কথা বলছেন। অন্যান্য সড়কে রিকশা চলবে। এ ছাড়া সার্ভিস রোড ও কয়েকটি জায়গায় রিকশা লেন করে দেওয়া হবে। কাজেই এটা ঠিক নয় যে, প্রধান সড়ক থেকে রিকশা তুলে দিলে চালকরা না খেয়ে থাকবেন। আর এখন গ্রামাঞ্চলেও শ্রমিক পাওয়া যায় না। সেখানে একজন শ্রমিকের মজুরি ৫০০ টাকা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, স্বল্প দূরত্বে যেখানে হেঁটে যাওয়া যায়, সেখানেও রিকশায় যাওয়ার অভ্যাস পাল্টাতে হবে। তিনি বলেন, রিকশা বন্ধ হওয়া প্রত্যেকটি সড়কে পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করা হবে। আর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ছয়টি কোম্পানি করা হচ্ছে। খুব শিগগির একটি কোম্পানি এ ব্যাপারে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ শুরু করবে।