বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৮ রমজান ১৪৪৫

ইসলামি বিপ্লবের পূর্বকথা

তরুণ কণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত : ০৬:০৪ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার

ওই সব আল্লাহওয়ালাদের সংস্পর্শে আমার অন্তর এই হকিকত উপলব্ধি করে যে, কুরআনের প্রকৃত মর্ম হলো দুনিয়া জুড়ে ইনকিলাব কায়েম করা। এবং আজকের দুনিয়াতেও কুরআনে বিশ্বাসী প্রত্যেকের জন্য ফরজ তার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ‘ইনকিলাব’ করা। 

আমি আমার সুমহান মুর্শিদদের প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ যে, তারা আমার স্বভাবগত সাধারণ যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে বিশ্বব্যাপী মানুষের মুক্তিতে নিবেদিত মনোভাবে বদলে দেন, এবং আমার জীবনের উদ্দেশ্যকে গতিময় করেন। 

এই কারণে আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য কুরআনে নির্দেশিত বিশ্বব্যাপী মানুষের মুক্তির এই সংগ্রাম। এবং একে কার্যত বাস্তবায়নের জন্য সবরকমের চেষ্টাপ্রচেষ্টা আমার একমাত্র কাজ। 

আমার মতে ইনকিলাবি মনোভাবই ব্যক্তির খুদিকে জাগিয়ে তোলে, আর যখন মানুষের আপনসত্তা জেগে ওঠে তখন সে কোনো রকমের ভয়ডর ছাড়া তার ওপর আপতিত সব অনাচার-অবিচার বীরবিক্রমে রুখে দেয়, তারপর নীতিহীন আদর্শ আর অন্যায় আইনের ভিত তীব্র আক্রমণে ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলে, অবশেষে গড়ে তোলে জীবনের নতুন বুনিয়াদ। 

সোজা কথায় চূড়ান্ত মুক্তির প্রথম ধাপ হলো ‘ইনকিলাবি ঝোঁক’, এই ইনকিলাবি ঝোঁকই ফিকির ও কার্যতৎপরতা তৈরি করে। এই ঝোঁকই রুশ জনগণের মধ্যে মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য হিম্মত ও সাহস জুগিয়েছে, ফলে তারা শাহেনশাহ জারের অপরাজেয় রাজসিংহাসন ভেঙে চুরমার করে ফেলে। 

তারপর এমন শাসন প্রতিষ্ঠা করে, সারা দুনিয়া যার বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু আমজনতার ইনকিলাবি ঝোঁক কাউকে পরোয়া করেনি, এবং আত্মবিশ্বাস ও একিনের সঙ্গে প্রত্যেক শত্রুকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। 

জেহাদ ও ইনকিলাব বিষয়ে এখানে একটি আলাপ সবিস্তারে না বললেই নয়: মানুষ জেহাদ বলতে সাধারণত তলোয়ার চালনা বন্দুকের নল দাগানো আর দেশ দখল বোঝে, আর ইনকিলাব বলতে বোঝে কোনো সমাজব্যবস্থা ভাঙা, বিপ্লব, রক্তপাত, ধ্বংস, তোড়জোড় ইত্যাদি। 

কিন্তু জেহাদ মানে বন্দুকের নল দাগানো নয় আর ইনকিলাবও নয় স্রেফ ভাঙচুরের প্রতিশব্দ। কুরআনে হাদিসে জেহাদকে নানা ক্ষেত্রে নানান অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় রক্তপাতের জেহাদের অস্তিত্ব নাই। সেটিও আছে। 

জেহাদ তলোয়ারেও হয়, কলমেও হয়, জবানেও হয়, অন্তরেও হয়, বেশিরভাগ তো নিজের প্রবৃত্তির সাথেই নিজের জেহাদ করতে হয়। 

একইভাবে ইনকিলাবের অর্থ কেবল ভাঙচুর আর প্রথাবিরোধিতা না। সমাজে চলে আসা প্রাচীন রীতিনীতির বিপরীত ধারণা পেশ করাই ইনকিলাবি কাজ নয়, বরং বিদ্যমান সকল ব্যবস্থার জায়গায় কোনো উন্নত ও জীবন্ত ব্যবস্থা সামনে আনাই প্রকৃত ইনকিলাব। 

আমরা ভুলবশত মনে করি পুরানো সব নিয়মকানুন মিটিয়ে দেওয়ার নাম ইনকিলাব। এইজন্য আমজনতা ইনকিলাব ভালো চোখে দেখে না। শুধু নতুন ধারণা আর প্রগতিকে উন্নত মনে করা ইনকিলাবের প্রকৃত মর্ম অনুধাবন করতে না পারার দলিল। 

ইনকিলাবের মূলনীতি হলো তা কেবল ওইসব ধারণাই মিটিয়ে দিবে যা টিকিয়ে রাখবার মতো নয়। ইনকিলাব প্রাচীনত্বকে ইনকার নয়, উলটো তা মানবেতিহাসের সমস্ত ‘বাকিয়াত ও স-লিহাত’ (উত্তরাধিকার ও স্থায়ী সৎকর্ম) তার অবস্থানে অক্ষত রাখে,—যাকে অক্ষত রাখা জরুরিও বটে,— এবং নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনে তার থেকে পুরোপুরি সহায়তা নেয়। 

নদীর স্রোত যদি বয়ে যায়, তো কেবল সামনের দিকেই এগিয়ে যায়, কিন্তু মাঝপথে যদি বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন তা উপচে পড়ে, আমরা তাকে বলি বন্যা— ইনকিলাব ঠিক এমনই। 

নতুনত্ব ও প্রগতিশীলতার মধ্য দিয়ে মানুষ শতশত বছরে যেই অবস্থানে পৌঁছায়, ইনকিলাবের মধ্য দিয়ে অল্পসময়ে সেই অবস্থানে অথবা তার চেয়ে এগিয়ে অনেকদূর চলে যাওয়া যায়। 

অবশ্যই বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় ইনকিলাব বস্তুবাদী ও যান্ত্রিক ইনকিলাব, কিন্তু এ জরুরি নয় ইনকিলাব চিরকাল বস্তুবাদী ও যান্ত্রিক হবে, বরং খুবই সম্ভাবনা আছে আগামীদিনের ইনকিলাব হবে মানুষের আত্মিক উৎকর্ষ ও বৌদ্ধিক বিকাশের ইনকিলাব। 

কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ লেখেন, ‘মানুষের বিবর্তনের পরবর্তী ধাপ শারীরিক নয় বরং আত্মিক ও বৌদ্ধিক। প্রথমে মানুষ বিবর্তনের মাধ্যমে ইতরশ্রেণির প্রাণী থেকে মানুষের স্তরে এসেছে, তারপর সে দেমাগ খাটিয়ে নিজেকে শক্তিশালী করে, যন্ত্র ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করে, বর্তমানে সে উন্নতির চূড়ান্ত উৎকর্ষে অবস্থান করছে। এখন তার জন্য জরুরি এই অবস্থান অতিক্রম করা। অর্থাৎ যেই বিবর্তন মানুষকে ইতরশ্রেণির প্রাণী থেকে মানুষে উন্নীত করেছে, তারপর মানুষ নিজের প্রয়োজনেই অস্ত্রশস্ত্র ও যন্ত্র উৎপাদন করেছে, ওই বিবর্তনই মানুষকে আরও সামনে আগাতে বাধ্য করবে, পরবর্তী স্তরের দিকে ঠেলে দিবে। কিন্তু সামনের সেই স্তর আর বস্তুবাদী উৎকর্ষতা হবে না, হবে রুহানি ও বুদ্ধিবৃত্তিক।’

আমার দৃষ্টিতে ইউরোপের এই বস্তুবাদী ইনকিলাবও অদূর ভবিষ্যতে সুনিশ্চিতভাবে মানুষের বৌদ্ধিক ও আত্মিক উৎকর্ষতার ইনকিলাবে পরিবর্তিত হবে। ইউরোপীয়রা এখন যেমন বস্তুগত উন্নতিকেই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ভাবে, তখন আত্মিক উন্নতিকেও ঠিক তা-ই ভাবতে বাধ্য হবে। 

নিঃসন্দেহে আমি হালের বস্তুবাদী ইনকিলাব মন ও প্রাণ দিয়ে সমর্থন করি, এবং এবিষয়ে আমার বক্তব্য হলো : ইউরোপীয়দের দুইশ বছরের বিপ্লব ও সংগ্রাম দুনিয়া জুড়ে তন্ত্র মন্ত্র ও যন্ত্রে যে পরিবর্তনের হাওয়া লাগিয়েছে আর বিজ্ঞান যে মোজেজা দেখিয়েছে, তাকে ইনকার করা মানে আমাদের প্রগতির ওই স্তর থেকে অনেক অনেক পেছনে হটে আসা।

আমি চাই ইউরোপের এই বস্তুবাদী প্রগতিকে গ্রহণ করে নিতে। অর্থাৎ জ্ঞান ও বিজ্ঞানের উন্নতি আমাদের পার্থিব জীবনের ভিত্তি মজবুত করবে। কিন্তু এর মানে এই নয় বিজ্ঞান আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রের সমাধান বাৎলে দিবে। বিজ্ঞান যে বস্তুগত ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধন করেছে এ নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই, আমার কথা হলো জীবন স্রেফ বস্তুতে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ অণুর সমষ্টি বটে, কিন্তু অণু রুহের ওপর নির্ভর, এবং সেই রুহ আবার অন্য এক মহাশক্তির ওপর নির্ভর— যিনি ‘হাইয়ুল কাইয়ুম’ (চিরঞ্জীব)। 

আমি ম্যাটারিয়ালিস্টিকদের বিশ্বজগৎ সম্পর্কে ধারণাকে ভুল মনে করি না, তবে অবশ্যই অসম্পূর্ণ মনে করি। বস্তুবাদী ধারণা ইনকার করি না, আমি জানি তারা যা বলে তা বস্তুর প্রতিভাস (Phenomenon) সম্পর্কে ঠিক, কিন্তু বস্তুর প্রকৃতরূপ (Noumenon) হলো অবিমিশ্র সত্য— যার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে আছে, ইসলামের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘গায়েব’। 

জীবন সম্পর্কে বস্তুবাদী ধারণা একপেশে ধারণা, একটি দিকের কথাই বলে কেবল, কিন্তু যথাযথ ও পরিপূর্ণ ধারণা আল্লাহর এই কালামে প্রকাশ পায়— রব্বানা আ-তিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওফিল আ-খিরাতি হাসানা’ (সুরা বাকারা : ২০১) 

অর্থ : হে আল্লাহ, আমাকে দুনিয়াতে কল্যাণ দাও, আখেরাতেও কল্যাণ দাও।

এই ধারণা বস্তুর প্রতিভাস ও প্রকৃতরূপ দুটোকেই শামিল করে, জীবনের জন্য দুটোর প্রয়োজনই সমান প্রমাণ করে। 

সুতরাং উপমহাদেশে ইউরোপের মতো ইনকিলাব হতে আমার কোনো আপত্তি নাই, কিন্তু জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সাহায্যে ইউরোপ যে ভোগবাদী মানসিকতার দিকে চলে গেছে আমি চাই এখানে তা না হোক। 

এই ইনকিলাব কেবল বস্তুবাদী ইনকিলাবে সীমাবদ্ধ না থাকুক। আমার দৃষ্টি তো প্রত্যেক মানুষের প্রতি, প্রত্যেকের সম্পর্ক বিশ্বআত্মার সাথে হবে, আর প্রত্যেকেই হবে অভিন্ন— আমি একেই ইসলাম মনে করি। কিন্তু আমার মতে যতক্ষণ না বস্তুজগতের ওপরের মানুষের কর্তৃত্ব এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত ফায়দা প্রত্যেকেই সমানভাবে না পাবে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের পরিপূর্ণ ইসলাম ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। 

ইসলামি হুকুমত আল্লাহর নির্ধারিত হুকুমত, আর হুকুমত অর্থ আল্লাহর নেয়ামত আল্লাহর সকল বান্দার মধ্যে ন্যায্যমাফিক হওয়া। 

এই ভিত্তির ওপর আমি ইউরোপের বস্তুবাদী ধারণাকে ইসলামের বিপরীত মনে করি না, বরং পরিপূরকরূপে জ্ঞান করি। এবং যতক্ষণ না ইউরোপের বস্তুবাদী ইনকিলাবকে নিজেদের করে না নিব, ইসলামের বিশ্বব্যাপী ইনকিলাবের ধারণা লজ্জাই পাবে কেবল।