বৃহস্পতিবার   ১০ অক্টোবর ২০২৪   আশ্বিন ২৫ ১৪৩১   ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

শায়েস্তা খাঁর চাল বাঙালির ভাত

তরুণ কণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত : ০৬:০৫ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২১ বুধবার

কয়েন থাকলেও কেউ সেটা ধরতে চান না। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দেয়া ঘোষণা কার্যকর হলে কিছুদিনের মধ্যে বাজার থেকে দুই টাকার নোট-কয়েনও উঠে যাবে। শায়েস্তা খাঁর সময়ে এক টাকায় আট মণ চাল মিলতো সত্য। ওই এক টাকা আয় করা দুরূহ ছিল তাও সত্য। দেশে সেই খোরাকি অর্থনীতি নেই। বিশ্ববাস্তবতাও নেই।

কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে চাল, ডাল, আটা, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়েনি। সেটা দ্বিগুণ-ত্রিগুণও। দাম কমার সম্ভাবনাও নেই। জাতিসংঘের বিশ্ব ও খাদ্য সংস্থা এমন পরিস্থিতি আভাস দিয়েছে এক বছর আগেই। শুল্ক হ্রাস, ভর্তুকি দেয়াসহ নানা পদক্ষেপে দেশে-দেশে সরকারগুলো তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু, সাফল্য ধরা দেয় না। বাজারে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা থাকলে দ্রব্যমূল্য হাতের নাগালে আনতে সহায়ক হয়। কিন্তু, সেই নমুনা নেই। প্রচুর স্টক ও সরবরাহ থাকলেও আধুনিক দুনিয়ায় নিয়ন্ত্রণ আনার পথ থাকে না। আজ শায়েস্তা খাঁ বেঁচে থাকলেও তাই হতো। এটাই নিষ্ঠুর বাস্তবতা।

 অল্প কিছু মানুষের ঘরে আছে মাছ, মাংস, ফল, দুধসহ খাবারের প্রাচুর্য। অন্যদিকে বেশির ভাগ মানুষের থালায় ভাত আর আলুভর্তা, ডাল বা ছোট মাছ কিংবা শাক ছাড়া কিছু নেই। কোনো ঘটনার খেসারত বোঝাতে বাঙালির একটি প্রবাদবাক্য হচ্ছে-‘কত ধানে কত চাল’। এখনকার বাস্তবতায় সেটার ‘কত চালে কত ভাত’-এর অবস্থা। 

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া এবং জাহাজ ও কন্টেইনার খরচ বেড়ে যাওয়ার শিকার বাংলাদেশ। তারওপর বাংলাদেশে ডলারের দামও বেড়েছে। এই ৩ কারণ থাকলে পণ্যের বাজার চড়তে আর কিচ্ছু লাগে না। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয় বলে আন্তর্জাতিক বাজারের বড় প্রভাব কাজ করে দেশের বাজারে। তারওপর বেড়েছে অতি মুনাফার প্রতিযোগিতা। তবে, কম দামে পণ্য দেয়ার প্রতিযোগিতা নেই বললেই চলে।

কোভিড-উত্তর সময়ে বিভিন্ন দেশে পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক সরবরাহে সংকট প্রকট হয়েছে। এ সুযোগে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির মওকা হয়েছে। এক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ছিলো আটশ ডলার যা এ মূহুর্তে চলছে ১৪৮০ ডলার ধরে। সাড়ে ছয়শ ডলারের পাম অয়েলের দাম এখন ১৩২০ ডলার। আবার ৩০০ ডলারের চিনি বেড়ে হয়েছে ৫১০ ডলার। ২১০ ডলারের গম এখন বিক্রি হচ্ছে ৫১০ ডলারে। দাম বাড়া নিয়ে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, দোকানদারদের যুক্তির পাল্লা তাই যথেষ্ট ভারি।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো পরিবহন খরচ বেড়েছে। পণ্য কিনেও চাহিদা মতো জাহাজ ও কন্টেইনার পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে আমদানীকারকদের। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য সমস্যাটি আরো বেশি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা। অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত পণ্যগুলো বাজারে আসতে আসতে দাম চড়ে যাচ্ছে বেহাল পরিবহন ব্যবস্থা ও চাঁদাবাজির শিকার হয়ে। বাড়তি খরচটা ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের কাছ থেকেউ উশুল করে। আর ক্রেতাদের সিংহভাগই সাধারণ শ্রেণির। ভেতো বাঙালি, হাভাতে বাঙালিসহ কতো অপবাদ তাদের। আবার এই ভাতের জন্যই কতো লড়াই।

একেক দেশে একেক খাদ্যাভ্যাস থাকলেও বেশিরভাগ দেশে গম, ধান, আলু প্রায় অভিন্ন। এসব শস্য উৎপাদন করে কৃষক ন্যায্য দাম তো দূরের কথা, সরকার নির্ধারিত দামও পায় না। আবার বাজারে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়। বিশেষ করে চাল। বর্তমানে মোটা চাল ৪৮-৫২ টাকা, মাঝারি চিকন চাল ৬০ টাকা এবং চিকন চাল ৭০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বড়াই করে বলা হয়ে থাকে, খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার টন। বর্তমানে বিশ্বে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে। কথা মিথ্যা নয়। এছাড়া সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে সপ্তম, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে বাংলাদেশ। হিসাব শক্ত এবং সঠিক।

গোলমালটা তো অন্য জায়গায়। জনসংখ্যার তুলনাটা আড়াল করার বদঅভ্যাস রয়েছে আমাদের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। আর খাদ্য উৎপাদন ১ কোটি ১০ লাখ টন। ফলে অভাব ছিল। এখন জনসংখ্যা ১৭ কোটি। আর খাদ্যশস্য উৎপাদন সাড়ে চার কোটি টনের বেশি। অর্থাৎ জনসংখ্যা বেড়েছে দুই গুণের একটু বেশি। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণের বেশি। আবার মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। মানুষের আয়-আয়ুর কিন্তু ব্যাপক উন্নতি। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২৫৫০ ডলার ছাড়িয়েছে। মাথাপিছু এতো আয়ে মাথা খোয়া গেলেই বা কী? মরেও শান্তি? তারওপর করোনার সময়েও দেশের অনেক ব্যবসায়ীর আয় হয়েছে ১০০ থেকে ১৭০ কোটি ডলার। বেতনের সঙ্গে কামাই বাড়ছে চাকরিজীবীদের। কিছু মানুষকে গরীব বলা হলেও মাথাপিছু আয়ের গড়ের অংকে তারাও ধনবান। কিন্তু, পকেট ফাঁকা। অল্প কিছু মানুষের ঘরে আছে মাছ, মাংস, ফল, দুধসহ খাবারের প্রাচুর্য। অন্যদিকে বেশির ভাগ মানুষের থালায় ভাত আর আলুভর্তা, ডাল বা ছোট মাছ কিংবা শাক ছাড়া কিছু নেই। কোনো ঘটনার খেসারত বোঝাতে বাঙালির একটি প্রবাদবাক্য হচ্ছে-‘কত ধানে কত চাল’। এখনকার বাস্তবতায় সেটার ‘কত চালে কত ভাত’-এর অবস্থা।