শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১   ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

কোরআন পড়ো, জীবন গড়ো!

ডেস্ক

কক্সবাজার সৈকত

প্রকাশিত : ০৫:৩৭ এএম, ২৬ নভেম্বর ২০১৮ সোমবার

প্রতিটি মানুষের কিছু না কিছু জীবনধারা থাকে। নিত্যকিছু কাজের মাঝ দিয়ে জীবনের সময়গুলো চলে যায়। খাওয়া দাওয়া ঘুম থেকে নিয়ে কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব পালনসহ নানা রকম নিয়মতান্ত্রিক কাজ করতে হয়।

এসবের মাঝেই জীবনের নিয়মগুলো বাঁধা। তবে নিত্য দিনের এসব কাজের সঙ্গে প্রত্যহ সকালে কোরআন পাঠের সূচিটাও জীবনকে রাঙ্গিয়ে দিতে পারে নতুন করে। প্রভাতের শীতল হাওয়ার সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত সতেজ করে তুলবে আপনার মন ও দেহ। আত্মায় বইয়ে দিবে প্রশান্তির হাওয়া। নবী করিম (সা.) এর উত্তম জিকির ছিল কোরআন তেলাওয়াত। দীর্ঘ সময় তিনি কোরআন তেলাওয়াতে ব্যায় করে দিতেন। নামাজে কোরআনের দীর্ঘ অংশ তেলাওয়াত করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন। ডুবে যেতেন কোরআন সাগরে। সেই সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি পবিত্র কোরআনের একটি অক্ষর পড়বে, সে একটি নেকি পাবে। আর একটি নেকি দশটি নেকির সমপরিমাণ। (তিরমিজি শরিফ)

এ ছাড়াও মানবসমাজের মাঝে সর্বোত্তম মানব হিসাবে কোরআনের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকেই ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কোরআন শিক্ষা করে এবং অন্যদেরকে শিক্ষা দেয় ‘(বুখারি)।

আর যে কোরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি কোরআন মুখস্ত করবে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করবে এবং তা মুখস্থ করবে এবং (বিধি-বিধানের প্রতি) যত্নবান হবে, সে উচ্চ-সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গে অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি কষ্ট হওয়া সত্তেও নিজেকে সম্পৃক্ত রাখবে সে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে। (বুখারি, মুসলিম)

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন পড়ানো এবং তেলাওয়াতের কারণে আমার কাছে কিছু চাইতে পারল না, আমি তাকে প্রার্থনাকারীর চেয়েও বেশি দান করি।’

পরকালেও এ কোরআন মুক্তির হাতিয়ার। কোরআনের বিনিময়ে মানুষ আরহন করবে জান্নাতের সুউচ্চ আসনে। হাদিসে রয়েছে, কিয়ামত দিবসে কোরআন অধ্যয়কারীকে বলা হবে, কোরআন পড় এবং উপরে উঠো। যেভাবে দুনিয়াতে তারতীলের সঙ্গে কোরআন পড়তে সেভাবে পড়। যেখানে তোমার আয়াত পাঠ করা শেষ হবে, জান্নাতের সেই সুউচ্চ স্থানে হবে তোমার বাসস্থান (তিরমিজি)।

অপর এক হাদিসে বলা হয়েছে, জান্নাতের সিঁড়ির সংখ্যা হচ্ছে কোআনের আয়াতের সংখ্যা পরিমাণ। কোরআনের পাঠককে বলা হবে, তুমি যতটুকু কোরআন পড়েছ ততটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠ। যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ কোরআন পড়েছে, সে আখেরাতে জান্নাতের সর্বশেষ সিঁড়ির ধাপে উঠে যাবে। যে ব্যক্তি কোরআনের কিছু অংশ পড়েছে সে ততটুকু উপরে উঠবে। অর্থাৎ যেখানে তার পড়া শেষ হবে সেখানে তার সওয়ারের শেষ সীমানা হবে।

রাসূল (সা.) এর মতো এ কোরআনও পরকালে এর তেলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে। রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা কোরআন পাঠ কর। কেননা কিয়ামত দিবসে কোরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হবে। (মুসলিম) অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন রোজা ও কোরআন বান্দার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। (আহমাদ, হাকেম)

রাসূল (সা.) বলেন, কোনো সম্প্রদায় যদি আল্লাহর কোনো ঘরে একত্রিত হয়ে কোরআন পাঠ করে এবং তা পরস্পরে শিক্ষা লাভ করে, তবে তাদের ওপর প্রশান্তি নাজিল হয়, আল্লাহর রহমত তাদের আচ্ছাদিত করে এবং ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে। আল্লাহ তাঁর নিকটস্থ ফেরেশতাদের সামনে তাদের কথা আলোচনা করেন। (মুসলিম) কোরআনুল কারীমের এ মর্যাদাশীল ফজিলত মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি উপহার ও রহমত স্বরূপ। কোনো ইবাদতের মাধ্যমে পরকালে মুক্তি আসবে তা নির্ধারণ সম্ভব নয়। তবে আল্লাহ ও তার রাসূলের ঘোষিত প্রিয় আমলগুলো প্রত্যহ চালিয়ে যাওয়া বান্দার একান্ত কর্তব্য। হয়তো এ কোরআনের বিনিময়ে পরকালের কঠিন স্তরগুলো পার হয়ে যাবে বান্দা। তাই কোরআন তেলাওয়াত প্রত্যহ জীবনেরই একটি অংশ বানিয়ে নেওয়া মুমিনের দায়িত্বও বটে।

তবে কোরআনকে শুধু তেলাওয়াতের মাঝে সীমাব্ধ রাখলেই হবে না। কোরআনকে ধারণ করতে হবে জীবনের নানা ক্ষেত্রেও। কোরআনের সকল আদেশ ও নিষেধ মেনে চলতে হবে। যেসকল বিষয়ে আদেশ করেছেন তা করা ও যেসকল বিষয়ে নিষেধ করেছে তা পরিহার করাই কোরআনের দাবি।

কোরআনে ধৈর্য্যর বর্ণনা: ধৈর্য্য মানুষের মহত গুণ। ধৈর্য্যশীলদের পছন্দ করেন আল্লাহ তায়ালা। কথা আছে ‘ধৈর্য্যে মেওয়া ফলে’। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে মানুষকে ধৈর্য্য ধারণের কথা বলেছেন। ধৈর্য ধরতে হবে দুঃখ কষ্টে, বিপদে-আপদে। ধৈর্য্য ধারণ বিষয়ে কোরআনে উল্লেখিত কয়েকটি আয়াত জেনে নিন।

‘সে পুত্র যখন তার সঙ্গে কাজ-কর্ম করার বয়সে পৌঁছলো তখন একদিন ইব্রাহিম তাঁকে বললো, ‘হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি যবেহ করছি, এখন তুমি বল তুমি কি মনে করো?’ সে বললো, ‘হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন।’ (সূরা: আস সাফ্ফাত, আয়াত: ১০২)

‘অতএব, হে নবী, তুমি উত্তম ধৈর্য্য ধারণ করো।’ (সূরা: আল মাআরিজ, আয়াত: ৫)

‘হে নবী! তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে যে হেদায়াত পাঠানো হচ্ছে তুমি তাঁর অনুসরণ করো। আর আল্লাহ ফায়সালা দান করা পর্যন্ত সবর করো এবং তিনিই সবচেয়ে ভালো ফায়সালাকারী।’ (সূরা: ইউনুস, আয়াত: ১০৯)

‘হে মুহাম্মাদ! এসব গায়েবের খবর, যা আমি তোমাকে অহীর মাধ্যমে জানাচ্ছি। এর আগে তুমি এসব জানতে না এবং তোমার কওমও জানতো না। কাজেই সবর করো। মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম।’ (সূরা: হুদ, আয়াত: ৪৯)

‘আর সবর করো কারণ আল্লাহ সৎকর্মকারীদের কর্মফল কখনো নষ্ট করেন না।’ (সূরা: হুদ, আয়াত: ১১৫)

‘হে মুহাম্মাদ! সবর অবলম্বন করো- আর তোমার এ সবর আল্লাহরই সুযোগ দানের ফলমাত্র- এদের কার্যকলাপে দুঃখ করো না এবং এদের চক্রান্তের কারণে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ো না।’ (সূরা: আন নাহল, আয়াত: ১২৭) ‘অতএব, হে নবী, দৃঢ়চেতা রাসূলদের মত ধৈর্য ধারণ করো এবং তাদের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করো না। এদেরকে এখন যে জিনিসের ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে যেদিন এরা তা দেখবে সেদিন এদের মনে হবে যেন পৃথিবীতে অল্প কিছুক্ষণের বেশি অবস্থান করেনি। কথা পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে। অবাধ্য লোকেরা ছাড়া কি আর কেউ ধ্বংস হবে?’ (সূরা: আল আহক্বাফ, আয়াত: ৩৫)

‘তোমার পূর্বেও অনেক রাসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে কিন্তু তাদের ওপর যে মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে এবং যে কষ্ট দেয়া হয়েছে, তাতে তারা সবর করেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌঁছে গেছে। আল্লাহর কথাগুলো পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারোর নেই এবং আগের রাসূলদের সঙ্গে যা কিছু ঘটে গেছে তার খবর তো তোমার কাছে পৌঁছে গেছে।’ (আল আন’আম : ৩৪)

‘হে নবী! মুমিনদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করো। তোমাদের মধ্যে বিশজন সবরকারী থাকলে তারা দু’শ জনের ওপর বিজয়ী হবে। আর যদি এমনি ধরনের একশ জন থাকে, তাহলে তারা সত্য অস্বীকারকারীদের মধ্য থেকে এক হাজার জনের ওপর বিজয়ী হবে। কারণ তারা এমন এক ধরণের লোক যাদের বোধশক্তি নেই।’ (আল আনফাল: ৬৫)

‘অতএব তোমার রবের চূড়ান্ত ফায়সালা পর্যন্ত ধৈর্য্যসহ অপেক্ষা করো। এবং মাছওয়ালার (ইউনুস আলাইহিস সালাম) মতো হয়ো না, যখন সে বিষাদ ভারাক্রান্ত হয়ে ডেকেছিলো।’ (আল কলম: ৪৮ )

কোরআনে দয়া অনুগ্রহ:

মহান আল্লাহ তায়ালা অসীম দয়ালু। তার দয়ার কোনো শেষ নেই। তিনি দয়াশীলদের পছন্দ করেন। তবে যারা দয়া করার পর খোটা দেয়, কটূক্তি করে তাদের দয়ার কোনো মূল্য নেই। পক্ষান্তরে যারা দয়া করে এসব কাজ থেকে বিরত থাকে তাদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান। নিম্মে উল্লেখিত কোরআনের কয়েকটি আয়াত এ কথাই প্রমাণ করে। ‘যারা তাদের সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে এবং যা ব্যয় করেছে তারপর তিরস্কার ও প্রকাশ্য অপমান করে না, তারা তাদের পুরস্কার পাবে তাদের প্রভুর কাছে, এবং তাদের কোনো ভয় থাকবে না, না তারা দুঃখ করবে।’ (সূরা বাকারা : ২৬২)

‘হে মুমিনরা! তোমাদের যাদের বিশ্বাস আছে, তোমাদের দানকে বাতিল করো না তিরস্কার ও প্রকাশ্য অপমানের মাধ্যমে, তাদের মতো যারা তাদের সম্পদ ব্যয় করে যেন লোকজন দেখে এবং তাদের কোনো বিশ্বাস নেই আল্লাহ ও শেষ দিনে। তাদের উদাহরণ হলো একটি পাথর যা মাটি দিয়ে ঢাকা: প্রবল বর্ষণ তাকে আঘাত করে ও একে অনাবৃত করে ফেলে। তাদের কোনো শক্তি নেই কোনকিছুর ওপরে যা তারা উপার্জন করেছে, এবং আল্লাহ বিশ্বাসহীন দলকে পথ দেখান না।’ (সূরা বাকারা : ২৬৪)

‘তারা এটিকে তোমার প্রতি একটি উপকার মনে করে যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে। বল, ‘আমার প্রতি কোনো উপকার মনে করো না তোমাদের ইসলাম গ্রহণ করাকে। বরং আল্লাহ তোমাদের ধন্য করেছেন যখন তিনি তোমাদের বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করেছেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।’ (সূরা আল ইমরান : ১৭)

এ সকল বাণী দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে দয়া, অনুগ্রহ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন। বিষয়গুলোর গুরুত্ব বুঝানোর জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। তারপরও মুমিনদের ঘুম না ভাঙলে আফসোস ছাড়া কিছু করার নেই।

সূত্র : অর্থবোধক শব্দগুচ্ছে আল-কোরআন, (বিষয়ভিত্তিক আয়াত অভিধানসহ)