শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৫ ১৪৩১   ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
১৩৪৭

৫,২৩,১৯০ কোটি টাকার বাজেট

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৩ জুন ২০১৯  

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেছেন। এটি দেশের ৪৮তম এবং বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। একই সঙ্গে আ হ ম মুস্তফা কামালের অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বাজেট। এর আগে তিনি পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবেও বাজেট প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন।

‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। দেশের ৪৮ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট এটি। এর আগে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি অর্থবছরের ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট দেন।

বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। বাজেট অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বিদেশী কূটনীতিকবৃন্দ এবং দেশের বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন।

শুরুতে দাঁড়িয়ে বাজেট বক্তৃতা শুরু করলেও পরবর্তীতে স্পিকারের অনুমতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজ আসনে বসে প্রস্তাবিত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন। পরে অর্থমন্ত্রী অসুস্থতা অনুভব করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজেট উপস্থাপন করেন। অর্থমন্ত্রী গত কয়েক দিন বাজেট নিয়ে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করায় সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি হাসপাতাল থেকে সরাসরি সংসদে যোগ দেন।

সংসদে উপস্থাপিত প্রস্তাবিত ২০১৯-২০১২০ অর্থবছরের বাজেট পাস হবে আগামী ৩০ জুন। ১ জুলাই থেকে নতুন বাজেট কার্যকর হবে।

বাজেট উপস্থাপনের আগে মন্ত্রিসভা ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের অনুমোদন দেয়। বাজেট ঘোষণার আগে দুপুর দেড়টায় জাতীয় সংসদ ভবনে বিশেষ বৈঠকে মন্ত্রিসভা এ অনুমোদন দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার এ বিশেষ বৈঠক হয়।

বৈঠকে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। তবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে না পারা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থ খরচ করতে না পারায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয় ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী বাজেটের আকার সংশোধিত বাজেট থেকে ৮০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা বেশি।

বাজেট দলিল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয় ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এটি পরবর্তীতে বাড়তে কিংবা কমতে পারে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এটি ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেটে ছিল ৩ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।

রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অধীন আয় ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত করব্যবস্থা থেকে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এছাড়া, সরকারের বিভিন্ন সেবার ফি, হাসপাতালের টিকিট মূল্য, সেতুর টোলসহ বিভিন্ন খাত থেকে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে।

অভ্যন্তরীণ আয়ের বাইরে আগামী অর্থবছরে বিদেশ থেকে ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার আশা করছে সরকার। অনুদান যেহেতু ফেরত দিতে হয় না, তাই এ পরিমাণ অর্থ পাওয়া গেলে মোট আয় দাঁড়াবে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ৪ হাজার ৫১ কোটি টাকা অনুদানের আশা করলেও বাজেট সংশোধনকালে তা কমিয়ে ৩ হাজার ৭৮৭ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে।

ব্যয়ের খাত : ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার মধ্যে নতুন অর্থবছরের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা, যা আগে অনুন্নয়ন ব্যয় হিসেবে উল্লেখ করা হতো। এর মধ্যে সরকারের আবর্তক ব্যয় ২ কোটি ৭৭ লাখ ৯৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ৫২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ৪ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এছাড়া, সরকারের মূলধন খাতে ৩২ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

নতুন অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। সেখান থেকে ইতোমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাবদ ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল (এনইসি)। এছাড়া, এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্প, স্কিম ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে বাকি অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।

সাধারণত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ অবকাঠামোর সংস্কার কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সরকার। এ খাতে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা।

ঘাটতি অর্থায়ন : অনুদান না পেলে নতুন বাজেটে ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের ৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে, কোনো দেশের বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে থাকলে তা ঝূঁকিপূর্ণ নয়। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার ঘাটতি ধরা হয়েছিল, যা ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জন না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি বাড়িয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা ধরা হয়, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। তবে বিদেশি অনুদান পাওয়া গেলে নতুন অর্থবছরে ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

এ ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে ৭৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সেখান থেকে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে ১১ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে নিট বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। বাকি ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেওয়া হবে, এরমধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

চলতি অর্থবছর ব্যাংক খাত থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।

এছাড়া, ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে নিট ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে, যার মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য থাকলেও উচ্চ সুদহারের কারণে মানুষ এ খাতে বেশি বিনিয়োগ করেছে। ফলে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়।

জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি : প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ধরা হয় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে এ প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কম থাকবে। ফলে অন্যান্য পণ্যের দাম কিছুটা নিম্নমুখী থাকবে। এদিক বিবেচনায় নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

করের আওতা বাড়ছে : দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অর্থমন্ত্রী রাজস্ব বাড়াতে আয়কর সহজ করার দিকে নজর দেন। তার বাজেট বক্তৃতায়ও বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে জনগণের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে এর আওতা বাড়ানো ঘোষণা দেন। এ বিষয়ে  নতুন করে ৮০ লাখ করদাতা বাড়ানোর কথাও তিনি উল্লেখ করেন। বর্তমানে কর দিচ্ছেন দেশে এমন লোকের সংখ্যা ২০ লাখ। করের আওতায় ১ কোটি লোককে আনা হবে। করের আওতা বাড়াতে সারা দেশে জেলা ও উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৯ লাখ হাট-বাজারের করযোগ্য ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে এর আওতা বাড়ানো হবে। এছাড়া, করযোগ্য হলেও যারা কর দিচ্ছেন না, দেশব্যাপী তাদের শনাক্ত করে করের আওতায় আনা হবে।
 

এই বিভাগের আরো খবর